|| বিশ্ব বলপূর্বক অন্তর্ধান দিবস || World Forceful Disappearance Day

 

|| বিশ্ব বলপূর্বক অন্তর্ধান দিবস ||

ডিজ্যাপিয়ার অর্থাৎ উধাও হয়ে যাওয়া। ঘটনাটি ম্যাজিকের মত মজাদার শোনালেও পৃথিবীর ইতিহাসে এটি কোনো আনন্দদায়ক উপলক্ষ নয়। প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ পৃথিবীর বুক থেকে নিমেষে হারিয়ে গেছে, তার হদিশ পরিবার তো দূরে থাক কাকপক্ষী কেউ টের পায়নি। কোনো গ্রাম্যবালক, কোনো জার্নালিস্ট বা কোনো আর্মি অফিসার কেউই এই লিস্ট থেকে বাদ যাননি।
২০১৮ সালের ৮ই জানুয়ারি, ইজিপ্টের রাস্তা থেকে দিনের আলোর মধ্যে গায়েব হয়ে যায় খালিদ হোসেন, তারপর বহু মাস তাঁর কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। বেশ কিছুদিন পর তাঁকে যখন খুঁজে পাওয়া যায় তখন তার অন্তর্ধান থাকাকালীন অভিজ্ঞতার কথা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। না, এটা কোন স্বেচ্ছা অভিবাসন বা অ্যাডভেঞ্চারের লোভে অন্তর্ধান নয়। ইজিপ্টের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি দিনের আলোর মধ্যে তুলে নেয় হোসেনকে। তারপরে মাসের পর মাস চলতে থাকে অকথ্য অত্যাচার। চূড়ান্ত শারীরিক যন্ত্রণা, বারংবার ধর্ষিত হওয়ার পরেও হোসেন জানতে পারেন না তার প্রকৃত অপরাধ কী। তাঁর পরিবারকেও জোর করে দেশ ছাড়া করা হয়। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ায় খুব অল্প পরিমাণে জানা যায় এ রকমই একজন গুপ্ত কয়েদির কথা। জন বা উইটনেস জে, নামে পরিচিত এই ব্যক্তি ছিলেন একজন মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স অফিসার।
তাঁকে বন্দী করা হয় আলেকজান্ডার মাকোনোচি সেন্টারে। তাঁর বন্দী থাকার খবর বহুকাল দেশের কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
১৯৯২ সালে আলজেরিয়ান সিভিল ওয়ার চলাকালীন বহু মানুষকে আটক করা হয় ১৯৯৭ সাল অব্দি তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এইরকম হদিশহীন মানুষের সংখ্যা এই দেশে প্রায় ১৭ হাজার ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্তর্ভুক্ত সময়ে প্রায় ৫০০ জন ব্যক্তিকে গুপ্তভাবে আটক করে রাখা হয়। ২০১০ অব্দি চলতে থাকা এই আটকের পিছনে ছিল বাংলাদেশের সুরক্ষা বাহিনী। ২০১০ সালের ২৫শে জুন বিরোধী দলনেতা চৌধুরী আলম, ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশ নেশনালিস্ট পার্টির বিরোধী নেতা ইলিয়াস আলীকে গ্রেফতার করা হয় এবং তারপর থেকে তাঁদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। চায়নায় গেধুন চএকি নাইমা তাঁর পরিবারসহ রাতারাতি উধাও হয়ে যান। মনে করা হয় এই ঘটনার পিছনে ছিল চতুর্দশ দলাই লামা এবং তেনজিন গিয়াতসো। এই পরিবারকে চায়নার মাটিতে আর কোনদিন দেখা যায়নি। চাইনিজ সরকারের দাবি তারা জীবিত এবং অক্ষত রয়েছেন। এই ভৌতিকভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় একটি নাম না নিলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেটি হল ভারত বর্ষ। ২০১১ সালের জম্মু কাশ্মীর মানবাধিকার কমিশন একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরে যে উত্তর কাশ্মীরে প্রায় ২,১৫৬ জন মানুষের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। মনে করা হয়, কবর দেওয়া এই দেহগুলি গত ১২ বছর ধরে চলা বিদ্রোহ দমন কৌশলের প্রতিরূপ।
এইরূপ অনৈতিক উধাও এর ঘটনা পৃথিবীজুড়ে বহু দেশে বারবার উঠে এসেছে। আর্জেন্টিনা, বস্নিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, এল সালভাদর, জার্মানি, গুয়েতেমালা, ইরাক, মেক্সিকো, নর্থ কোরিয়া, রাশিয়া, আমেরিকা লিস্টটি বেশ দীর্ঘ। এদের নাম দেশের কোন জেলে নথিভুক্ত করা থাকে না। এদের পরিবারের এইটুকু জানার অধিকার থাকে না যে তাদের প্রিয়জন আদৌ জীবিত না মৃত। ২০০৫ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রথম খবর উঠে আসে আমেরিকান সেনাবাহিনী ও তাদের গোয়েন্দাবিভাগের 'আন-ল-ফুল এনিমি কমব্যাটেন্স' অর্থাৎ অনৈতিকভাবে শত্রু দমনের কথা যা তারা শুরু করে ইরানের 'আবু গারিব' নামক জেলে সম্ভাব্য দোষীদের বন্দি করে।
নিখোঁজ মানুষগুলির খোঁজ পাওয়া যায় বহু বছর পরে বিদেশের কোনো এক শহরে হাসপাতলে চিকিৎসাধীন অথবা মৃত অবস্থায়। তাদের উদ্ধারকার্যে পৃথিবীর প্রায় ১৮৯ টি ন্যাশনাল রেডক্রস সংস্থা এগিয়ে এসেছে। ২০০৬ সালের ২০শে ডিসেম্বর ইউনাইটেড নেশনস জেনারেল অ্যাসেম্বলি প্রথম পদক্ষেপ রাখে অনৈতিক আটকের বিরুদ্ধে। ৩০শে আগস্ট 'আন্তর্জাতিক বলপূর্বক অন্তর্ধান দিবস' (World Day of Victims of Enforced Disappearance) পালিত হয় সেই সকল মানুষের কথা মনে করে যারা দিনের পর দিন বিনা নোটিশে বা হয়তো বিনাকারণে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী থেকেছে আর অমানুষিক মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করে গেছে; হয়তো কোনো একদিন পুনরায় তাদের পুরোনো জীবন, পরিবার ফিরে পাবার আশায়। এই দিনটি পালনের প্রথম প্রস্তাব উঠে আসে 'ল্যাটিন আমেরিকান ফেডারেশন অফ অ্যাসোসিয়েশন ফর রিলেটিভ অফ ডিটেইণ্ড ডিজেপিয়ার্ড' (Federación Latinoamericana de Asociaciones de Familiares de Detenidos-Desaparecidos বা FEDEFAM) থেকে। এই বেসরকারি সংস্থাটি ১৯৮৯ সাল থেকে অনৈতিক অপহরণের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে।
অনৈতিক অপহরণের ঘটনাগুলি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়মের বিপক্ষে। বহু সংস্থা এর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে কাজ করে চললেও আজও একের পর এক প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবী থেকে। রাষ্ট্রশক্তির এই বর্বর কৌশল গ্রহণ করার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? তারা কি এতই দুর্বল যে কিছু মানুষের স্বপ্ন বা মতাদর্শ তাদের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিতে পারে? জিজ্ঞাসা চিহ্নটা রয়েই যায় সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর অস্তিত্বের মতোই।
লেখা - Su Kannya
ডিজাইন - Rafi

Comments