বিনোবা ভাবে (Binova Bhave)



বিনায়ক নরহর ভাবে, যিনি বিনোবা ভাবে নামেও পরিচিত; তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা তার পরবর্তী সময়ের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় আমরা হয়তো ওনার নাম পড়িনি, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে ওনার বুদ্ধিদীপ্ত সক্রিয়তা গান্ধীজিকেও অবাক করেছিল। ১৮৯৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের গাগদি অঞ্চলে তাঁর জন্ম হয়। জীবনের প্রথম আট বছর তিনি সেই কোঙ্কনী গ্রামেই কাটান। বাবার চাকরিসূত্রে পরবর্তী ১৩ বছর তিনি বরোদায় থাকেন। শৈশব কাল থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। বই পড়ার প্রতি তাঁর ছিল অগাধ উৎসাহ।

শৈশব কালে তিনি মনস্থির করেন যে বাকি জীবনটা তিনি ব্রহ্মচর্য হিসেবে কাটাবেন। আধ্যাত্মিক চিন্তা ও পরাধীন দেশের মুক্তির প্রকল্প তাঁকে ঘিরে থাকত সবসময়। ২৫শে মার্চ ১৯১৬ সালে তিনি পুঁথিগত শিক্ষায় ইতি টেনে বারাণসী পাড়ি দেন। বারাণসীতে থাকাকালীনই তিনি একজন মানুষের বক্তৃতা শোনেন যিনি সাউথ আফ্রিকায় থাকা ভারতীয়দের কষ্টের কথা সেই সময়ে চিন্তা করছেন। গান্ধীজীর বক্তৃতায় তিনি এতটাই উৎসাহিত হন যে তাঁকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির উত্তরে তিনি পেয়েছিলেন গান্ধীজীর তরফ থেকে পাঠানো বিশেষ আমন্ত্রণপত্র। ৭ই জুন ১৯১৬ সালে বিনায়ক আমেদাবাদ যান। গান্ধীজীর সাথে কথা বলে তিনি আধ্যাত্বিকতার এক নতুন মানে খুঁজে পান। তাঁর এযাবৎকালীন চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো উন্নত ও সুসংহত পথে পরিচালনা করার রাস্তা খুঁজে পান।
ধীরে ধীরে বিনায়ক হয়ে ওঠেন সবরমতী আশ্রমের এক উল্লেখযোগ্য সদস্য। স্বদেশী কাজ করার সাথে সাথে তিনি শিশুদের শিক্ষাদান, খাদির বস্ত্র নির্মাণ এবং কৃষিকাজেও হাত লাগানো শুরু করেন। মহারাষ্ট্রের অন্যতম দুজন সন্তের নাম অনুসারে গান্ধীজী বিনায়ক এর নামকরণ করেন বিনোবা।
সাহিত্য চর্চায় বিনোবা বিশেষ পারদর্শীতার পরিচয় দেন। ১৯২৩-১৯২৭ সাল পর্যন্ত 'মহারাষ্ট্র ধর্ম' নামক একটি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। সংস্কৃত ভাষাকে তিনি সাধারণ মানুষের পাঠ যোগ্য করার পরিকল্পনা করেছিলেন যা বহু মানুষের শিক্ষায় সহায়তা করেছে। ১৯৩০-১৯৩১ সালের মধ্যে তিনি ভগবৎগীতাকে মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করেন। প্রায় চার লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রি হয় তাঁর অনুবাদিত লেখার। বিনোবা স্বদেশীর কারণে বহুবার জেলে গিয়েছেন। ১৯৩২ সালে ধুলিয়া জেলে থাকাকালীন ভগবত গীতার আঠারোটি অধ্যায় রচনা করে প্রকাশ করেছিলেন 'গীতা প্রবচন' নামে। তাঁর লেখা এই রচনাটি ২৩টি ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে পর্তুগীজ, জার্মান, জাপানিজ ও কোরিয়ান ভাষাতেও এর অনুবাদ হয়েছে।
গান্ধীর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছিলেন তার ওয়ার্ধা আশ্রমের একজন নিয়মনিষ্ঠ সদস্য। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি গান্ধীর আদর্শ ও বার্তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন, তৈরি করেন 'সর্বোদয় সমাজ'।
বিনোবা প্রথম 'বুধন আন্দোলন' শুরু করেন। আন্দোলনে তিনি সকল অর্থবান জমিদারকে এগিয়ে আসতে বলেন দুঃস্থ ভূমিহীন কৃষকদের স্বার্থে। আন্দোলনে তিনি কোনো মহৎ দানশীলতার দাবি করেননি, তিনি মনে করতেন পৃথিবীর আলো-বাতাস জলের মতোই ভূমিও সকলের সমানভাবে প্রাপ্য। বুধন আন্দোলনে প্রায় ৫ লক্ষ জমি উঠে আসে যার মধ্যে ৩ লক্ষ জমি দান করা হয় দুঃস্থ পিছিয়ে পড়া মানুষদের। সেই মানুষগুলি যাতে চিরকালীন রোজগারের একটি পন্থা লাভ করে সেটা নিশ্চিত করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য।
গীতা প্রবচনের সাথে তিনি রচনা করেন আরো বহু উল্লেখযোগ্য সাহিত্য। 'গীতাই চিন্তানিকা', 'বিচারপতি', 'স্বরাজ্য শাস্ত্র' প্রভৃতি গ্রন্থ মারাঠি ভাষায় যুগান্তকারী রচনা হিসেবে এখনও গণ্য হয়। রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার এক অদ্ভুত মিলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন এই মানুষটি। তুখড় বুদ্ধিধর একজন আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও তিনি দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। অতি সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়েই তিনি প্রমাণ করেন তাঁর প্রকৃত দেশপ্রেম। তাঁর জীবনের শেষ কিছুদিন তিনি মধ্য ভারতের একটি আশ্রমে কাটিয়ে দেন। ১৯৮২ সালের ১৫ই নভেম্বর অনেক স্মৃতি ও ইতিহাস সৃষ্টি করে, তার সাক্ষী হয়ে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন।

ডিজাইন -
Ramesh

Comments