|| আর. কে. নারায়ণ ||



এখানে অনেকেরই ছোটবেলার কথা মনে পড়লে, ভেসে আসে ডিডি ন্যাশনাল-এর "মালগুড়ি ডেস"-এর সেই অদ্ভুত মন কেমন করা সুরটা। তখন আমরা আর একবার ঝালিয়ে নিতে পারি আমাদের আনস্মার্ট ছোটবেলাটা। মারপ্যাঁচ, হিংসা হানাহানি, শত্রুকে 'দেখে নেব' জাতীয় মনোভাবের ছিটেফোঁটা বিহীন এই গল্প গুলি যেন আমাদের আলাদাই এক প্রশান্তি দিত। আর এর পুরো কৃতিত্বটাই প্রায় গল্পকারের। যিনি সমস্ত জাগতিক খারাপ-লাগা গুলিকে দূরে ঠেলে রেখে গড়ে তুলেছিলেন একটি বাস্তবিক অথচ কাল্পনিক সমাজ। যেখানে না থাকে বড় হওয়ার তাড়া, না থাকে বর্তমান সমাজের সমস্যাগুলি। তৎকালীন সমস্ত বয়সের মানুষকে এই বাঁধভাঙ্গা ভালোলাগার রাস্তাটা দেখিয়েছিলেন রাশিপুরাম কৃষ্ণস্বামী আইয়ার নারায়ণস্বামী, যিনি বিশেষভাবে পরিচিত আর. কে নারায়াণ নামে।
১৯০৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজত্বকালে মাদ্রাসের একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। নারায়ণের প্রাথমিক শিক্ষা বাবার বিদ্যালয়েই হয়। বাবার বদলির চাকরি থাকার দরুন তাঁর ছোটবেলা কাটে মামার বাড়িতে। মামার বাড়িতে ঠাকুমার কাছেই তাঁর গণিত, পুরান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং সংস্কৃতের শিক্ষা। ঠাকুমার সাথে তাঁর সখ্যতার অনুরণন রয়ে যায় তার লেখা 'গ্র্যান্ড মাদারস টেল' রচনায়।
শিশুকাল থেকেই নারায়ণ ছিলেন চার্লস ডিকেন্স, আর্থার কোনান ডয়েল, ওডহাউস, টমাস হার্ডির মতো লেখকদের শরণার্থী। স্কুল শেষের পরে তিনি মাইসোরে বাবার কাছে ফিরে আসেন। বাড়ির গ্রন্থাগারে অগাধ বইয়ের সমাহার, সেখানে তিনি নতুন করে পড়াশোনা শুরু করার সাথে সাথে নিজের আরেকটি শখ আবিষ্কার করেন। শুরু হলো তাঁর লেখালেখির যাত্রাপথ।
কলেজে ডিগ্রী শেষ করে একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন কিন্তু প্রধান শিক্ষকের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার পরই তিনি স্থির করেন লেখালেখি তাঁর জীবনের একমাত্র পেশা হওয়া সম্ভব। তাঁর জীবনের প্রথম প্রকাশিত লেখা হিসাবে একটি বইয়ের পর্যালোচনা করেছেন। ধীরে ধীরে তিনি স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লেখা জমা দেওয়া শুরু করলেন। যদিও প্রথমের দিকে লেখা থেকে তিনি খুব বেশি উপার্জন করতে পারেন নি, প্রথম বছরে তাঁর রোজকার ছিল নয় টাকা বারো আনা তৎকালীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের খরচ চালাবার মতো মোটেই নয়। এরপর তিনি লেখেন "স্বামী এন্ড ফ্রেন্ডস", যেটা বহু প্রকাশক না পড়েই নাকচ করে দেন। তার পরেও নারায়ণ হাল ছাড়েননি।
১৯৩৩ সালে কোয়েম্বাটরে তাঁর বোনের বাড়ি গিয়ে রাজম নামে এক ষোড়শীর প্রেমে পড়েন। বিবাহের পর দ্যা জাস্টিস নামক একটি মাদ্রাসি পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ নেন। এখান থেকেই ধীরে ধীরে তাঁর উত্তরনের সূচনা।
বহুদিন আগেই নারায়ণ "স্বামী এন্ড ফ্রেন্ডস" অক্সফোর্ড প্রকাশনীতে পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তা গ্রাহাম গ্রিনের নজরে আসায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই (১৯৩৫ সালে)। এরপর তিনি পরপর দুটি বই প্রকাশ করেন 'দ্যা ব্যাচেলর অফ আর্টস' এবং 'দ্যা ডার্ক রুম'। তাঁর রচনায় যেমন নির্মল শৈশব উঠে এসেছে তেমনি প্রকাশ পেয়েছে কলেজ রাজনীতি এবং ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে মহিলাদের ওপর দমন।
আর. কে নারায়ণের সাধারণ ইংরেজি লেখনী বহু মানুষকে ইংরেজি সাহিত্যের দিকে উৎসাহিত করেছিল। তৎকালীন ভারতবর্ষের ছবি তিনি যেভাবে তুলে ধরেছিলেন তাতে এখনো আমরা বেশ কয়েক দশক পিছনে পৌঁছে যেতে পারি।
সাহিত্যিক জীবনে নারায়ণ বহু পুরস্কার ভূষিত হয়েছিলেন। "দা গাইড" বইটির জন্য ১৯৫৪ সালে তিনি পান সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে সেই বইটি থেকে নির্মিত ছায়াছবির জন্য তিনি পান ফিল্ম ফেয়ার আওয়ার্ড। এর দশ বছর পরে তিনি পদ্মভূষণ লাভ করেন। রয়েল সোসাইটি অফ লিটারেচার এবং আমেরিকান অ্যাক্যাডেমি অফ আর্টস এন্ড লেটার এর সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। বহুবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য তিনি নির্বাচিতও হয়েছেন।
২০০১ সালে ৯৪ বছর বয়সে এই মানুষটি মারা যান আর রেখে যান অসাধারণ কিছু যুগান্তকারী লেখা। তাঁর প্রত্যেকটা সৃষ্টি বই-প্রেমীদের কাছে এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ার কাজ করে।

Comments