|| উইকিলিকস ||



কখনও ভেবে দেখেছেন আমেরিকার মত একটা দেশকে কীভাবে গুটিকয় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট মিলে এমন নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে; যার ফলে রাষ্ট্রের সুরক্ষার ভিতটারই টালমাটাল অবস্থা? গোটা পৃথিবীর কাছে অসীম শক্তিশালী আমেরিকার ছবিটা উঠে আসে এক মুখোশ খসে পড়া হাস্যাস্পদ হিসাবে।
দলটি হল উইকিলিকস নামক একটি ওয়েবসাইট যা তৈরি হয় ২০০৬ সালে আইসল্যান্ডে। ২০১৫ সালে অর্থাৎ ১০ বছরে প্রায় দশ লক্ষ তথ্য ফাঁস করেছে এই সংস্থা। উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা হলেন অস্ট্রেলিয়ান জার্নালিস্ট তথা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। এই ওয়েবসাইটটি শুরু হয় ৫ জন কর্মচারী নিয়ে এবং প্রায় ৮০০ জন মানুষ এখানে কাজ করতো অলিখিতভাবে। তথাকথিতভাবে কোন বিলাসবহুল ঝাঁ-চকচকে হেডকোয়াটার উইকিলিকসের ছিল না। কিছুদিন পরে তা ৭০ জন লেখক এবং স্বেচ্ছাসেবী কর্মচারীতে গিয়ে দাঁড়ায়।
আমেরিকা যা বহু যত্নে লুকিয়ে রেখেছিল এমন তথ্যাদি একের পর এক ফাঁস করতে থাকে উইকিলিকস। আফগানিস্তানের যুদ্ধ, কিউবার গুয়ান্তামোতে (আমেরিকার এক বিশেষ কারাগার, যা পৃথিবীর শেষ প্রান্তে প্রায় মাঝ সমুদ্রে অবস্থিত) অবৈধভাবে বিচারহীন বন্দি আটক, ২০১০-এ বাগদাদের ওপর আমেরিকার বিমান হামলা এবং তাতে মৃত্যু হওয়া ইরাকি সাংবাদিকসহ আরও বেশ কিছু বেকসুর মানুষের মৃত্যুর কথা তুলে ধরে উইকিলিকস। ২০১১ সালে উইকিলিকস প্রকাশ করে ৭৭৯ জন বন্দীদের গোপন ফাইল যাদের বিনা বিচারে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্দোষ অবস্থায় গুয়ান্তামোতে পাঠানো হয়। ২০১৬ সালে উইকিলিকস আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে প্রকাশ করে বসে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী প্রচারের সমস্ত গোপনীয় রাজনৈতিক তথ্য। অবাক করা ব্যাপার, তথ্যগুলি বেরিয়ে আসে হিলারি ক্লিন্টনের প্রচার সচিব জন পদেস্টা-এর তরফ থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতামত, ঠিক নির্বাচনের মুখোমুখি সময়ে উইকিলিকসের এই তথ্য প্রকাশের ঘটনায়, ক্লিনটনের প্রচার খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হয় যা, রাষ্ট্রপতিত্ব এর দৌড়ে তাঁকে পিছনে টেনে নিয়ে যায়। কানাঘুষোতে উঠে আসে যে বিশেষ ইমেইলগুলি ফাঁস করা হয় সেগুলো আসলে রাশিয়ার চুরি করা। রাশিয়া তথ্যগুলি উইকিলিকসের হাতে তুলে দিয়েছে বলে মনে করা হয়। উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে আমেরিকাসহ গোটা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায় যখন মানুষ জানতে পারে আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগ সিআইএ কি প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের এবং বিদেশের মানুষের মোবাইল হ্যাক করে। উইকিলিকস প্রকৃতপক্ষে জানায় যে, মানুষের তথ্য আসলেই তার একার নয়, রাষ্ট্রশক্তি তাকে প্রতিনিয়ত নজরে রেখে চলেছে।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পরে ২০১৮ সালে ক্রিস্টিন হেরফনসন প্রধান সম্পাদক হিসাবে উইকিলিকসের নিযুক্ত হন। তাহলে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কোথায়? যে উইকিলিকস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের নামেই পরিচিত, আজ সেই অ্যাসাঞ্জ জেলের পিছনে রয়েছেন। এই মানুষটি উইকিলিকস গড়তে কোডিং থেকে ফিন্যান্সের সব দায়িত্ব একা হাতে তুলে নিয়েছিলেন; আজ তাঁর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন তিনি ধীরে ধীরে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠছেন। এই ভীষণ প্রাণবন্ত মানুষটি আমেরিকার সিআইএ অফিসার চেলসা ম্যানিংয়ের সাহায্য নিয়ে একাই তদন্ত করে বার করেছেন একের পর এক গোপন তথ্য; আজ তিনি নিজেই অবসাদগ্রস্থ এবং আত্মহত্যার প্রবণতায় জর্জরিত।
উইকিলিকসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের কাছে রাষ্ট্রের সমস্ত সত্যি প্রমাণ সহ তুলে ধরা। উইকিলিকসের কাজ ম্যাক বা উইণ্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে হয় না। তারা ব্যবহার করে টেইলস অপারেটিং সিস্টেম (লিনাক্স distribution) যা পোর্টেবল এবং যথেষ্ট নিরাপদ। তাদের ওয়েবসাইটে একটি 'ড্রপবক্স' ব্যবস্থা চালু করেছিলেন যেখানে মানুষ এসে তাদের পরিচয় গোপন করে যেকোনো তথ্যাদি উইকিলিকসের সাংবাদিকদের হাতে তুলে ধরতে পারে। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংস্থা উইকিলিকসকে সংবাদমাধ্যমের এক নতুন দিগন্ত হিসেবে অভিহিত করেন। যদিও উইকিলিকস কতটা সংবাদমাধ্যম হিসেবে প্রযোজ্য সেই নিয়ে মতভেদ রয়েছে। উইকিলিকস আজ মনুষ্যচোখের বাইরে, তবু রাষ্ট্রের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের প্রশ্ন করার সাহস দেখিয়েছে এই মানুষগুলি। অ্যাসাঞ্জ, ম্যানিং বা স্নোডেনের মত কিছু মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে আজও বঞ্চিত। তবু তাঁরা গোটা পৃথিবীর মানুষকে শিরদাঁড়া সোজা রাখার সাহস যুগিয়ে চলেন, যাঁরা এখনো আশা রাখেন পৃথিবীকে এক অন্য দৃষ্টিতে দেখার।

ডিজাইন -
Rajdeep Singha Roy

Comments