আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা অবলুপ্তির স্মৃতি দিবস (International Day for Remembrance of Slave trade and Its Abolition)

 


পৃথিবী এমন একটা সময়ের সাক্ষী রয়েছে যখন মানুষজন কেনাবেচা হত পণ্যের ন্যায়। শাকসবজি বা ঘর সামলাবার টুকিটাকি সামগ্রীর মতই কিছু জলজ্যান্ত মানুষকে নিয়ে বিক্রির পসরা বসানো হত। তাদের বয়স, কর্মক্ষমতা এবং লিঙ্গ অনুযায়ী দাম নির্ধারিত থাকত।

সময়ের চাকা ঘোরার সাথে সাথে এই ভয়ানক প্রথার প্রচলন থেমে যায়। আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা অবলুপ্তির স্মৃতি দিবস এরকমই একটি দিনকে মনে করায় যেদিন এই শিউরে ওঠা মনুষ্য বিক্রয়ের বর্বরতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল চিরতরে। ডমিনিকান রিপাবলিকের একটি শহর সেন্ট ডমিঙ্গো (বর্তমানে হাইতি); যেখানে প্রথম ২৩শে আগস্ট, ১৯৯৮ সালে এই দিনটি পালিত হয়। ধীরে ধীরে এর উদযাপন ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীব্যাপী এবং এই দিনটি হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা অবলুপ্তি স্মৃতি দিবস। ইউনেস্কোর উদ্যোগে এই দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দাস প্রথার শিকার হওয়া সেই নিরীহ মানুষগুলোর কথা স্মরণ করা হয়। সেই মানুষগুলি নিজেদের হয়ে কোনো দিন বাঁচতে শেখেনি; কখনও হয়েছে কারোর ব্যবসায় মুনাফার যন্ত্র বা কারোর যৌন লালসার ক্রীড়নক।
এই চিত্রটা গোটা পৃথিবীতে কমবেশি একইরকম। দাসপ্রথার ভয়াবহতার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নিদর্শন ট্রানসাটলান্টিক দাসের ক্ষেত্রে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আটলান্টিক সাগরের মাধ্যমে ইউরোপ এবং আমেরিকার মধ্যে প্রচলিত হয় মানুষ চালাচালির এক অদ্ভুত পৈশাচিক ব্যবসা। সেই সময়ে পশ্চিম আফ্রিকায় ছিল পর্তুগিজ কলোনি; কিছুদিনের মধ্যে স্পেন এবং আমেরিকার মধ্যেও এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কারখানা ও চাষের ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াবার প্রয়োজনে এইসব শক্তিধর দেশগুলির প্রচুর সংখ্যক মানুষের প্রয়োজন পড়তে শুরু হয়। তখন তারা আফ্রিকা থেকে মানুষ আনাবার ব্যবস্থা পাকাপাকি করে। আফ্রিকার রাজা এবং জমিদারদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রের বিনিময় তারা একে একে গবাদি পশুর ন্যায় মানুষ কিনতে থাকে।
১৫১২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার রাজা আফোনসো ১ পর্তুগীজদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন যে তারা কঙ্গোর যুদ্ধবন্দীদের দাস হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এইভাবে আফ্রিকার কঙ্গো, দাহমে, ইয়োরুবা, বেনিন, আসান্তে প্রভৃতি বড় বড় সাম্রাজ্যগুলি একে একে তাদের শত্রুপক্ষের যুদ্ধবন্দীদের বিক্রি করতে থাকে প্রচুর পরিমাণ যুদ্ধের সামগ্রীর বিনিময়ে। পর্তুগীজদের পথ অনুসরণ করে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড ডেনমার্ক ও আফ্রিকা থেকে দাস আমদানির ব্যবসা শুরু করে। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ ২০ হাজার আফ্রিকান মানুষ ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে দাস রূপে। শুধুমাত্র স্পেন আর পর্তুগালেই প্রায় ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার মানুষ ক্রীতদাস হয়ে বন্দী থেকেছে বহুকাল।
এই মানুষগুলোর পরিচয় হয় তাদের হাতে বা পিঠে খোদাই করা নাম্বার দিয়ে। কখনো আবার দাস বিক্রয়ের রশিদ বা প্রমাণ হিসাবে কেটে নেওয়া হয় তাদের কান বা পায়ের আঙ্গুল। জাহাজে এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন অতিরিক্ত সংখ্যক মানুষকে জাহাজে তুলে নিতেন। উদ্দেশ্য একটাই, অতিরিক্ত মুনাফা। অন্যদিকে এই অসহায় মানুষগুলো মাসের পর মাস একটি বদ্ধ খোলের মধ্যে থেকে আলো বাতাস, খাদ্য বা উপযুক্ত স্যানিটেশনের অভাবে শেষ অবধি গন্তব্যস্থলে পৌঁছতেই পারতেন না। বলাই বাহুল্য মহিলা এবং শিশুদের রাখা হত জাহাজের ডেকের ওপর নাবিকদের মনোরঞ্জনের জন্য। অনেক সময় বহু কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ সেই প্রথমবার কোন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিকে দেখার পর আসন্ন বিপদের আশঙ্কা করে তখনই আত্মহত্যা করত, এই আশায় যে মৃত্যুর পর তাদের আত্মা বাড়ি ফিরে যেতে পারবে।
১৮০৭ সালে উইলিয়াম উইলবারফোর্স আমেরিকায় ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা পূর্ণরূপে বন্ধ করেন। কিন্তু আফ্রিকার ওপর এর ফল ছিল দীর্ঘস্থায়ী। ইউরোপ ও আমেরিকা মিলিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয় দাস হিসাবে। স্বাভাবিকভাবেই আফ্রিকার জনতাত্ত্বিক সংখ্যায় এর গভীর ছাপ পড়ে কারণ তাদের অধিকাংশ সমর্থ জনসম্পদকে বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করে গেছে বিদেশি শক্তি।
দাসপ্রথা থেমে গিয়েছে বহুকাল আগেই, কিন্তু রয়ে গেছে বর্ণবিদ্বেষ। তার প্রমাণ এখনও আমরা দেখতে পাই আমাদের ফেসবুকের টাইমলাইনে, খবরের কাগজের পাতায়, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে। ইউনেস্কো প্রতিবছর এই দিনটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষাবিদ অর্থনীতিবিদ এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। উদ্দেশ্য একটাই পৃথিবী থেকে এই বিষাক্ত নিয়ম-নীতিগুলো যেন চিরকালের মতো হারিয়ে যায়।

ডিজাইন -
Ramesh

Comments