বিশ্ব ভ্রমণ দিবস (World Travel Day)



 'ভ্রমণ' ব্যাপারটা এক অদ্ভুত অনুভূতি। যার কথা ভাবলেই 'বস'-এর চাপানো একগুচ্ছ অতিরিক্ত কাজ বা স্কুল-কলেজের হোমওয়ার্কগুলো এক নিশ্বাসে শেষ করে ফেলা যায়। ২৭শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব ভ্রমণ দিবস পালিত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে। দিনটি সেই সকল মানুষদের, যাঁরা হাঁপিয়ে ওঠা নাগরিক সমাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোনো পাব-এর আবছা অন্ধকারের নীচে এক রাত চূড়ান্ত উন্মাদনার মধ্যে কাটানোর থেকেও, কোনো পাহাড়ি গ্রামে বা কোনো নরম নদীর সাদা বালির মধ্যে রাত কাটানোর মধ্যেই বেশি মাদকতা খুঁজে পান।

ঘুরতে বেরোনোর প্রথা কিন্তু নতুন নয়। বহু প্রাচীন যুগে আমরা চীনা পরিব্রাজকদেরর কথা শুনেছি, কিন্তু ভ্রমণের জন্ম তারও আগে। প্রায় দু লক্ষ বছর আগে মানুষের প্রথম এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাড়ি দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই সময়ের মানুষেরা হোমো ইরেক্টাস নামে বিজ্ঞানের পাতায় অভিহিত রয়েছে। এরা হল মানুষের প্রথম শ্রেণী যারা আগুন এবং পাথরের ব্যবহার করতে শিখেছিল। এই হোমো ইরেক্টাস দলের যাত্রা শুরু হয় পূর্ব আফ্রিকা থেকে এবং একে একে তারা পৃথিবীর অন্যান্য অংশে নিজেদের বসতি স্থাপন করতে থাকে।
পরবর্তী কালে ইজিপ্টে ফারাওদের মধ্যে ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বহু লিখিত প্রতিলিপি থেকে জানা যায়, সাধারণত এরা বিভিন্ন স্তম্ভ বা প্রাসাদকেই ঘুরতে যাওয়ার জায়গার তালিকায় রাখতেন। ৪০০ থেকে ৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে গ্রীক দার্শনিক হেরোডোটাস ভ্রমণের চল আনেন। তার ফলস্বরূপ আমরা পাই ইতিহাসের অত্যন্ত মূল্যবান বহু তথ্য।
আজকে যখন আমরা মালদ্বীপের বিলাসবহুল সমুদ্রের উপর রিসোর্টে ছবি দেখি তখন কি এটা আন্দাজ করতে পারি যে সমুদ্রের গায়ে প্রাসাদোপম কোন বাড়িতে সময় কাটানোর অভ্যাস চলে আসছে যিশুখ্রিস্টের জন্মের মাত্র ১০০০ বছর পর থেকেই? রোমান রাজারা গ্রীষ্মের দিনে শুধুমাত্র স্নানের বিলাসিতার কারণে পাড়ি দিতেন গ্রীস বা ইজিপ্টের সমুদ্রতটে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার ফলে মধ্য ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে ভ্রমণ একটা বড় জায়গা করে নেয় উচ্চ থেকে মধ্যবিত্তদের মধ্যে। অন্য দেশে পাড়ি দেয়ার সাথে সাথে সপ্তাহান্তে গোটা দিনের এক একটা টুকরো ট্রিপও মানুষের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঘুরতে যাওয়ার নেশাটা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে আসতে আরো এক শতাব্দি সময় লেগেছিল। তারা একদিনের ছুটি নিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর শহরের কোলাহল ছেড়ে বেরিয়ে পড়তো জাহাজের ডেকে বা ট্রেনের থার্ড ক্লাস প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টে। ভ্রমণ থেকে পেশা বেছে নেওয়ার চলটা ১৮৬০ সাল থেকে শুরু হয়। আজকের দিনে যা আমাদের কাছে ফ্রীল্যান্স নামে পরিচিত তার সূচনা এই সময়কাল থেকেই। যারা চারদেয়ালের গণ্ডি থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়তে পেরেছে তারাই পরবর্তীকালে তাবড় লেখক, শিল্পী , স্থপতি বা সাংবাদিক হয়েছেন।
ভ্রমণের মাধ্যমে সাহিত্যের একটি অন্য আঙ্গিক উঠে আসে। উনবিংশ শতাব্দীর জার্মানিতে ভ্রমণকাহিনী লেখার বেস্ট সেলার ছিলেন কার্ল বেদেকার। ১৮২৭ সালে তিনি নিজের পাবলিশিং এজেন্সি খোলেন। লেখাগুলি শুধুমাত্র ভ্রমণের বর্ণনা নয়, আস্তে আস্তে হয়ে উঠতে থাকে ভ্রমণপিপাসুদের গাইড বুক।
ভারতীয়দের মধ্যেও যে এক অদম্য ভ্রমণপিপাসু সত্তা রয়েছে তা অষ্টাদশ শতাব্দীর উচ্চবিত্তদের দেখে জানা যায়। স্বাধীনতার পরে তা মধ্যবিত্তদের গণ্ডির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের নৈসর্গিক কিছু স্থান, যা শুধু শীতের দেশ থেকে আসা বিদেশি লর্ড এবং লেডিদের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল তা আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে ভারতীয়দের জনপ্রিয় ঘুরতে যাওয়ার জায়গা। আজও আমরা দার্জিলিং, উটি, মুসৌরি, পণ্ডিচেরী, মেখলিগঞ্জ এর মত জায়গায় গেলে কলোনিয়ালিজম এর গন্ধটা পাই। ৭০ বছরের পুরোনো সেই কলোনিয়ালিজম এর অনুভূতিটা আমাদের বর্তমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে মিশে যায়। মার্ক টোয়েন তাঁর বই 'ইণ্ডিয়া'-তে বলেছেন বিদেশি যে কোনো সম্রাট বা কৃষক, মূর্খ বা জ্ঞানী, স্বাধীন অথবা পরাধীন, ধনী কিংবা গরীব সকলেরই ভারতবর্ষকে চাক্ষুষ করার এক অদম্য বাসনা রয়েছে।
ইতিহাস বলছে ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভ্রমণ শাখাটি এই দিনে প্রথম ভ্রমণ দিবস পালন করে। আজকের দিনটি বেছে নেওয়া হয় কারণ ১৯৭০ সালে এই দিনে UNWTO (ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অরগানাইজেশন) বিশ্ব ভ্রমণ সংক্রান্ত বেশ কিছু আইন পাশ করে।
প্রতিবছর ভ্রমণ দিবসে একটি করে বিশেষ থিম পালন করা হয়। এবছরের থিম 'ভ্রমণ এবং গ্রামীণ উন্নতি'। এই বছরের লক্ষ্য হল শুধুমাত্র কোনো বিলাসিতার চাদরে মোড়া শহরে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সুন্দর গ্রামগুলিকেও ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের তালিকায় নিয়ে আসা। ফলে সেই গ্রামগুলি যেন মহামারী কালীন মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থা থেকে কিছুটা উঠে দাঁড়ায়।
ভ্রমণ আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই অতিমারীর সময়ে যাঁদের ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়া থেমে গিয়েছিল তাঁরা আস্তে আস্তে আবার বেরিয়ে পড়তে পারবেন। আবার কোন ভারতীয় ভ্রমণপিপাসু, কাউচ সার্ফিং করবেন পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে অচেনা কোনো গ্রামের ততোধিক অচেনা কোন ব্যক্তির বাড়িতে। এই ভাবেই মানুষ এগিয়ে যাবে মানুষের কাছে। বিশ্ব ভ্রমণ দিবসে সকলের উইশ লিস্টের পছন্দের জায়গাগুলি যেন একে একে দাগানো হয়ে যায় সেই আশা করলাম।

ডিজাইন -
Ramesh

Comments